Sunday, August 30, 2015

বাঁশের ফ্রেমে বিশ্বের বৃহত্তম ঘড়ি!

শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা। রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ মতিহার থানার কাপাশিয়া গ্রামের সরদারপাড়ার একটি আমবাগান ঘিরে কয়েক শ মানুষের জটলা। তারা সবাই গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে কয়েকটি নম্বরের দিকে। দিনের বেলায় কিছুটা দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে নম্বরগুলো কোনো সাংকেতিক চিহ্ন। কিন্তু আদৌ তা নয়। বিশাল বিশাল ডিজিটের এ নম্বরগুলো হলো ডিজিটাল ঘড়ির সময় নির্ণায়ক নম্বর, যা দেখে যে কারো চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। বাঁশের ফ্রেম দিয়ে ৭৮৫ বর্গফুটের বিশাল আকারের বিস্ময়কর এমনই একটি ঘড়ি তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রাজশাহীর কাপাশিয়া এলাকার মিঠু, যাঁর পুরো নাম আকুল হোসেন মিঠু। তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা। তাঁর বাবা মনতাজ সরদার কাটাখালী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। প্রায় দুই বছর ধরে পরিশ্রম শেষে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘড়িটির উদ্বোধন করার পর থেকেই সেটি এক নজর দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকেই ঘড়িটি দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করতে থাকে কাপাশিয়ার সরদারপাড়া গ্রামের মিঠুদের আমবাগানে। ঘড়ির উদ্ভাবক মিঠুর দাবি, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়, স্রেফ তাক লাগাতেই তাঁর এই উদ্ভাবন। মিঠুর দাবি, এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ঘড়ি। এর নির্মাণকাজে মিঠুকে সহায়তা করেছেন স্থানীয় আরো অন্তত ২৫ জন যুবক। এর বাইরে এলাকাবাসীও যে যার মতো আর্থিকভাবে অথবা উপকরণ দিয়ে সহায়তা করেছে মিঠুকে। আর প্রায় দুই বছরের কর্মযজ্ঞ শেষে গত শুক্রবার যখন ঘড়িটি আলো ছড়াতে থাকে, তখন নিমিষেই সব কষ্ট উবে যায় মিঠুদের; এমন অনুভূতির কথা জানালেন তিনি। মিঠু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সারা বিশ্বের কোথাও এভাবে স্থানীয় প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি এত বড় ডিজিটাল ঘড়ি নাই। জার্মানির বার্লিনের জাদুঘরে একটি ডিজিটাল ঘড়ি আছে অনেক বড় আকারের। তবে সেটিও সর্বোচ্চ সাড়ে ৩০০ ফুটের ওপরে নয়। তবে জার্মানির ওই ঘড়িটি তৈরি করা হয়েছে এলসিডি মনিটর দিয়ে। আর মিঠুদের ৭৮৫ বর্গফুটের ঘড়িটি তৈরি হয়েছে সেভেন ফিগমেন্ট ডিসপ্লে লাইট দিয়ে। ফলে এটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ডিজেটাল ঘড়ি। এর বাইরে গিনেস বুকেও এত বড় আকারের ডিজিটাল ঘড়ির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি মিঠুরা। ঘড়ির উদ্ভাবকদের দাবি, রাতের বেলায় ফাঁকা স্থান হলে অন্তত ১০ কিলোমিটার দূর থেকেও এই ঘড়িতে সময় দেখা যাবে। তবে জায়গার অভাবে মিঠুর ঘড়িটি আমবাগানের ভেতরে টানানোর কারণে সেটি খুব বেশি দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না। বাগানের গাছপালা বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কারণে এর আলো দূরে ছড়াতে পারছে না। বাগানের কাছাকাছি গেলেই কেবল এটি দেখা যাচ্ছে। উদ্ভাবকদের দেওয়া তথ্য মতে, এই ঘড়ির সংখ্যার উচ্চতা ১৭ দশমিক ৫ ফুট আর প্রস্থ ৪৪ দশমিক ৯ ফুট। বাড়ির বিদ্যুতের লাইন থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে সফটওয়্যারের সাহায্যে চালিত এই বিশাল ঘড়ি তৈরি হয়েছে ৪৮টি রড বাল্ব, স্টিলের বডি আর বাঁশের ফ্রেম দিয়ে; যেটি তৈরি করতে মিঠুদের খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। ঘড়ি উদ্ভাবনের প্রধান উদ্যোক্তা আকুল হোসেন মিঠুকে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তাঁরা ঘড়িটি নির্মাণ করেছেন। সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে গ্রাম-গঞ্জে এমন প্রতিভার যেন মূল্যায়ন করা হয় সেই লক্ষ্যেই ঘড়িটি নির্মাণ করা। এর জন্য কেউ দিয়েছে বাঁশ, কেউ বিদ্যুতের তার, কেউ বাল্বসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। আবার যারা কিছুই দিতে পারেনি, তারা দিয়েছে শ্রম। ফলে সবার ঐকান্তিক আর পরিশ্রমের ফসল হিসেবেই এই ঘড়ি তৈরি হয়েছে। মিঠু আরো জানান, তাঁর বাবা মনতাজ সরদারের স্বপ্ন ছিল, ছেলে আকুল হোসেন মিঠু বড় ইঞ্জিনিয়ার হবেন। কিন্তু মিঠু তা হতে পারেননি। রাজশাহী কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স পড়েই থেমে যেতে হয়েছে তাঁকে। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। অনেক দিন আগে থেকেই ইলেকট্রনিক সামগ্রীর কাজ করতে করতে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন মিঠু। সেই সঙ্গে বছর তিনেক আগে রাজশাহী থ্রি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড থেকে ১৫ দিনের মাইক্রোকন্ট্রোলার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন মিঠু। সেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মিঠু স্থানীয় প্রযুক্তিতে ডিজিটাল ঘড়ি তৈরির কাজে হাত দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে ও ইন্টারনেট থেকে সাহায্য নিয়ে বছর দুয়েক আগে হাত দেন ডিজিটাল ঘড়ি নির্মাণকাজে। এলাকার আরো কয়েকজন যুবক ও স্থানীয়দের নিয়ে শুরু করেন সেই কাজ। সেই থেকে এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় ঘড়িটির নির্মাণকাজ শেষ করেন মিঠু। এরপর সেই ঘড়ি শুক্রবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনও করেন তাঁরা। গতকাল বিকেলে ঘড়িটি দেখতে আসেন দুর্গাপুরের কলেজছাত্র সাব্বির রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এভাবে বাঁশের সাহায্যে স্থানীয় প্রযুক্তিতে তো বড় ডিজিটাল ঘড়ি তৈরির খবর কখনো শুনিনি। তাই দেখার জন্য চলে এসেছি।' এদিকে গতকাল সন্ধ্যার আগে আগেই ঘড়িটি এক নজর দেখার জন্য অন্তত হাজার দেড়েক লোকের সমাগম হয় মিঠুদের আমবাগানে। ঘড়ি দেখতে আসা এসব মানুষের মাঝেও আনন্দের ঢেউ লক্ষ করা যায়।
-------------------------------------------------------------------------------------------Kalerkantho

No comments:

Post a Comment